অন্তর্বর্তী সরকারের দশ মাসঃ অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা ও প্রশ্নবাণে জর্জরিত জনগণ

চক্ষু চিকিৎসার একমাত্র বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে গত পাঁচ দিন ধরে বন্ধ রয়েছে চিকিৎসাসেবা। প্রতিদিন যেখানে তিন হাজারের বেশি রোগী চিকিৎসা নেন এবং প্রায় দুই শতাধিক অস্ত্রোপচার হয়, সেখানে এখন সব কার্যক্রম বন্ধ। নিরাপত্তাহীনতায় চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অনুপস্থিত থাকায় স্থবির হয়ে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

সরকার কিংবা স্বাস্থ্য উপদেষ্টার পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেওয়া হয়নি। একইভাবে, সচিবালয়েও চলছে অচলাবস্থা। সচিবালয় কর্মচারী ঐক্য পরিষদের ডাকে চলমান আন্দোলন দুই সপ্তাহ ধরে স্থবির করে রেখেছে প্রশাসনিক কাজকর্ম। ‘একটি কালো আইন’ বাতিলের দাবিতে তারা অবস্থান কর্মসূচি পালন করলেও, সংকট নিরসনে সরকারে নেই দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ।

জ্বালানি সংকটে বিপর্যস্ত দেশের কলকারখানাগুলো। গাজীপুরে জ্বালানি উপদেষ্টার সরেজমিন পরিদর্শনের পরও কোনো কার্যকর সমাধান আসেনি। শিল্প-কারখানাগুলো কার্যত অচল হয়ে পড়েছে।

এর মধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকারের একাধিক উপদেষ্টার ব্যক্তিগত সহকারীদের বিরুদ্ধে ওঠেছে দুর্নীতির অভিযোগ। সর্বশেষ অভিযোগটি জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক ও সাবেক তথ্য-প্রযুক্তি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে, যার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রায় দেড়শ কোটি টাকার অনিয়মের। এর ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারকদের সততা ও জবাবদিহি নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে।

প্রচণ্ড জনসমর্থন নিয়ে গত বছরের আগস্টে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রমে মানুষের প্রত্যাশা ছিল আকাশচুম্বী। কিন্তু ১০ মাসে দেশের সার্বিক অবস্থা জনমনে গভীর হতাশা সৃষ্টি করেছে। জনগণের বড় একটি অংশ মনে করছে, এই সরকারও ধীরে ধীরে অতীতের ক্ষমতাসীনদের স্বৈরাচারী আচরণের ছায়া অনুসরণ করছে।

রাজনৈতিক অচলাবস্থাও কাটছে না। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ পরিণত হয়েছে অনিশ্চয়তা ও সময়ক্ষেপণের খেলায়। জনগণের অভিমত—এটি ‘সংলাপের নামে নাটক’। রাজনৈতিক ঐক্যকে পুঁজি করে ক্ষমতায় আসা এই সরকার এখন নিজেই বিভাজন সৃষ্টি করে ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ কৌশল নিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দিয়েও প্রধান উপদেষ্টার সাম্প্রতিক বক্তব্যে সে ইচ্ছার স্পষ্ট কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। বাস্তবে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের কোনো প্রস্তুতি নেই। অথচ এটি না হলে রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকেরা।

অন্তর্বর্তী সরকারের দ্বিতীয় ভিত্তি সশস্ত্র বাহিনী। এই বাহিনীর নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্বের কারণেই শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু সরকারের প্রতি আস্থাহীনতা তৈরি হলে এ বাহিনী কতটা কার্যকর থাকবে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। সম্প্রতি রংপুরে এক সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ এবং সেই ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর সামাজিকভাবে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।

অর্থনীতির চিত্রও আশাব্যঞ্জক নয়। সদ্য ঘোষিত বাজেটে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশার প্রতিফলন নেই বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। উন্নয়ন কিংবা অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে কোনো সুস্পষ্ট রোডম্যাপ নেই। বিদেশি বিনিয়োগ আহ্বানেও থাকছে কেবল কথার ফুলঝুরি। বাস্তবতা হলো—দেশীয় ব্যবসায়ীরাই সংকটে। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও নিরাপত্তার অভাবে অনেক উদ্যোক্তা ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

দেশজুড়ে বেড়েছে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি। মব সন্ত্রাস নতুন রূপে মব ফ্যাসিবাদে রূপ নিচ্ছে। প্রতিদিন খবরের শিরোনাম হচ্ছে সহিংসতা, অস্থিরতা ও অনিয়ম। সরকার ব্যস্ত নিজের এজেন্ডা বাস্তবায়নে, জনজীবনের বাস্তব সংকটগুলোর দিকে তাদের মনোযোগ নেই—এমনটাই বলছেন বিশ্লেষকরা।

দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সামাজিক নিরাপত্তা—তিনটি ক্ষেত্রেই ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এই অবস্থায় একমাত্র সমাধান হতে পারে অবিলম্বে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন। জনগণ এখন প্রশ্ন করছে—অন্তর্বর্তী সরকার কী সত্যিই সেই পথে এগোচ্ছে, নাকি অন্ধকার ভবিষ্যতের দ্বার খুলে দিচ্ছে?

কৃতজ্ঞতাঃ অদিতি করিম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *