সেনাপ্রধানের এখতিয়ার নিয়ে বিতর্কঃ প্রশ্ন উঠছে, অপপ্রচারের পেছনে কারা?

সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের ‘এখতিয়ার’ নিয়ে সম্প্রতি জনপরিসরে প্রশ্ন ও মন্তব্যের ঢল নেমেছে। আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের সময় তার ভূমিকা এবং পরবর্তীকালে জাতির উদ্দেশে ভাষণ, রাজনৈতিক নেতাদের সেনানিবাসে আমন্ত্রণ, ও জাতীয় নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বক্তব্য।

স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে—গণ-অভ্যুত্থানের পর দিন দেশবাসী অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিল কার ভাষণ শোনার জন্য? কে বলেছিলেন, “আমার ওপর ভরসা রাখেন”? সেই উত্তর সবার জানা—জেনারেল ওয়াকার। তখন কি কেউ প্রশ্ন তুলেছিল, “আপনি কে? কেন আপনার ওপর ভরসা রাখব?”—উত্তর ছিল না। বরং দেশের নানা প্রান্ত থেকে প্রশংসায় ভেসেছিলেন সেনাপ্রধান।

সশস্ত্র বাহিনী আবারও দেশের মানুষের আস্থার প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিজেও একাধিকবার সেনাপ্রধান ও সেনাবাহিনীর প্রশংসা করেছেন। ২০২৪ সালের ৬ অক্টোবর সেনা সদর নির্বাচনী পর্ষদের উদ্বোধনে তিনি বলেন—

“দেশের ক্রান্তিলগ্নে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে এবং একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে দেশকে এক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির হাত থেকে রক্ষা করেছে। ফলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আবারও দেশের মানুষের কাছে আস্থার প্রতীক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।”

এছাড়া ১৪ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন—

“আমি বিশেষ করে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে আবারও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। দেশের সব দুর্যোগকালে তারা সব সময় আন্তরিকভাবে এগিয়ে এসেছে… জনজীবনে স্বস্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় তাদের ভূমিকা অনন্য।”

সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকাকে স্বীকার করে তিনি আরও বলেন—

“দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে… আপনাদের প্রতি অনেক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।”

কিন্তু এরপরও, সম্প্রতি কিছু মহল সেনাপ্রধানের বক্তব্য ও ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। একটি টেলিভিশন টক শোতে মন্তব্য করা হয়—

“এখন যখন কারো মতলব পূরণের জন্য ওই ভদ্রলোক (সেনাপ্রধান) বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন, তখন বলা হচ্ছে, এটা উনি করতে পারেন না।”

বিশ্লেষক মহলের মতে, সেনাপ্রধান মনে করেন—দীর্ঘদিন সেনাবাহিনীকে মাঠে রাখলে পেশাগত ক্ষতি হতে পারে। সেখান থেকেই তিনি ১৮ মাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন চেয়ে মত দেন। অনেকে মনে করেন, এই বক্তব্য সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন।

কিন্তু বাস্তবে সংস্কার এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। দলগুলো এখনো ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের’ সভাঘরেই সীমাবদ্ধ। ফলে সেনাপ্রধানের ডিসেম্বর নির্বাচনের মতামত যাদের পছন্দ নয়, তারাই এখন ‘এখতিয়ারবহির্ভূত’ তত্ত্ব নিয়ে সক্রিয়।

রাজনৈতিক মহলে আলোচনা, সেনাপ্রধানের নেতৃত্বে গণ-অভ্যুত্থান সফল হলেও, তার সুফল যাদের হাতে গেছে, তারা এখন তাঁকে বিতর্কিত করতে তৎপর। এমনকি সরকারের একজন উপদেষ্টাও তাঁর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন, তাতেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া আসেনি।

গত ২১ মে অফিসার্স অ্যাড্রেসে সেনাপ্রধান বলেন—

“জাতীয় নির্বাচন আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই হওয়া উচিত।”

রাখাইন ইস্যুতে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান—

“সরকার কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, সে বিষয়ে সেনাবাহিনী এবং আমি অবগত নই।”
“সার্বভৌমত্বের জন্য ক্ষতিকর এমন কোনো কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কখনো যুক্ত হবে না। কাউকে তা করতেও দেওয়া হবে না।”

তিনি নির্দেশ দেন—সব সেনাসদস্য যেন নিরপেক্ষ থাকে এবং ভবিষ্যৎ নির্বাচনে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে।

তবে গণমাধ্যমে তার এই বক্তব্য নিয়ে কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি আইএসপিআর। যদিও ২৫ ফেব্রুয়ারি এক অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান বলেন—

“আমরা দেশে একটা ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ইনক্লুসিভ ইলেকশনের জন্য (সামনের) দিকে ধাবিত হচ্ছি… ড. ইউনূস যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন… তাঁকে আমাদের সাহায্য করতে হবে।”

এরপর ২৬ মে সেনা সদর আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে মিলিটারি অপারেশনসের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজিম-উদ-দৌলা বলেন—

“সরকার ও সেনাবাহিনী খুব সুন্দরভাবে একে অপরের সহযোগিতায় কাজ করছে। মিডিয়ায় যেভাবে আসছে, তা ভুল ব্যাখ্যা।”

সার্বিক পরিস্থিতিতে বিশিষ্টজনদের মূল্যায়ন, নির্বাচন প্রশ্নে সেনাবাহিনীর বক্তব্য কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন—

“স্থিতিশীলতা ও নির্বাচন প্রশ্নে বলতে হয়, অন্তর্বর্তী সরকারের এরই মধ্যে ৯ মাস চলে গেছে। এখন নির্বাচনের একটি সুনির্দিষ্ট তারিখ দেওয়া যুক্তিযুক্ত হবে।”

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন—

“আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা সেনাবাহিনীর কাজ না… সেনাপ্রধান হয়তো এই চিন্তা থেকেই ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনের পক্ষে নিজের মত প্রকাশ করেছেন।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন বেপারী বলেন—

“৫ আগস্ট তিনি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন… সেদিন সেনাপ্রধান ছাত্র-জনতার পক্ষে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত না নিলে দেশে রক্তের স্রোত বয়ে যেত।”

সাবেক সেনা কর্মকর্তা ড. খান সুবায়েল বিন রফিক বলেন—

“জেনারেল ওয়াকার ক্ষমতা নিতে চাইলে গত বছর আগস্টেই নিতেন। কিন্তু তিনি তা চাননি… তিনি এক কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন।”

কৃতজ্ঞতাঃ কালের কণ্ঠ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *