সেনাপ্রধানের বক্তব্য: একটি সময়োচিত সতর্ক বার্তা

২১ মে ২০২৫ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদর দফতরে বাহিনীর কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে সেনাপ্রধান যে বক্তব্য প্রদান করেছেন সেই বক্তব্যকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যেই গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানাবিধ আলোচনা সমালোচনার সূত্রপাত হয়েছে । যদিও বক্তব্যটি ছিল বাহিনীর অভ্যন্তরীণ দিক নির্দেশনার অংশ তথাপি তার প্রতিটি বাক্য আজ জাতীয় নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব এবং রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ দিক নির্দেশনা নির্ধারণে নিঃসন্দেহে গুরুত্ববহ হয়ে উঠেছে।

এখানে একথা মনে রাখা জরুরি, সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা হিসেবে সেনাপ্রধান শুধু একটি বাহিনীর নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তা কাঠামোর এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। যখন একটি অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বে তখন বিশেষ করে নির্বাচন পূর্ব সংবেদনশীল সময়ে সেনাবাহিনীর ভূমিকা কেবল প্রশাসনিক নয় বরং একটি স্থিতিশীল রাষ্ট্রব্যবস্থা রক্ষায় অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করে।

সেনাপ্রধানের বক্তব্যে “দেয়ার উইল বি নো করিডোর” বা “নির্বাচিত সরকার ১ জানুয়ারির মধ্যে দায়িত্ব নেবে” ইত্যাদি মন্তব্যগুলোকে অনেকেই রাজনৈতিক বলে প্রচার করছে। আমরা যদি বস্তুনিষ্ঠভাবে বিষয়টি পর্যালোচনা করি, তাহলে বুঝতে পারি—এগুলো রাজনৈতিক অবস্থান নয় বরং একটি পেশাদার সেনাপ্রধানের পক্ষ থেকে জাতীয় নিরাপত্তা এবং সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় সেনাবাহিনীর অবস্থান ও সহযোগিতাকে সুস্পষ্ট করা।

করিডোর প্রসঙ্গ: সার্বভৌমত্ব প্রশ্নে সুস্পষ্ট অবস্থান

মানবিক করিডোর বিষয়ক আলোচনা হঠাৎ করেই গণমাধ্যমে এসেছে। অথচ এই ধরনের স্পর্শকাতর বিষয়ে কোনো গণভোট বা রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত গৃহীত হয়নি। এমন একটি সিদ্ধান্ত যেটি জাতীয় নিরাপত্তা এবং ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্যকে প্রভাবিত করতে পারে সেটি নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমেই আসা উচিত। সেনাপ্রধান সেই অবস্থানই তুলে ধরেছেন মাত্র । এটি রাজনৈতিক নয় বরং জাতীয় স্বার্থে একটি দায়িত্বশীল অবস্থান।

অভিভাবকত্বের সংকট: একটি কাঠামোগত বিভ্রান্তি

সেনাপ্রধান তার বক্তব্যে যেভাবে “অভিভাবকহীনতা”র কথা বলেছেন, তা নিছক আক্ষেপ নয়, বরং তিনি একটি কাঠামোগত অব্যবস্থাপনাকে তুলে ধরেছেন তার এ বক্তব্যের ভেতর দিয়ে । বিগত বছরগুলোতে যেভাবে বাহিনী প্রধান গণ মহামান্য রাষ্ট্রপতি বা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি নির্দেশনায় পরিচালিত হতেন সেটিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একজন নিরাপত্তা উপদেষ্টার নিয়োগের মাধ্যমে কার্যকর করতে চেয়েছেন। উল্লেখ্য যে শেখ হাসিনা তার সামরিক উপদেষ্টা তারিক আহমদ সিদ্দীকীর মাধ্যমে তিন বাহিনীর যে অপূরণীয় ক্ষতি করেছেন সেই কথাটি বলাই বাহুল্য। হাসিনার অনুকরণে একটি সিভিল পজিশনে ‘নিরাপত্তা উপদেষ্টা’নিয়োগের মাধ্যমে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনায় অযাচিত হস্তক্ষেপের প্রচেষ্টা এক ধরনের অস্পষ্টতা তৈরি করেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সেনাপ্রধানের বক্তব্য নীতিগত, কৌশলগত ও ব্যবস্থাপনা জনিত অসঙ্গতিকেই তুলে ধরেছে।

গুজব ও অপপ্রচারের মুখে দায়িত্বশীল উচ্চারণ:

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে কিছু দেশি ও বিদেশি মিডিয়া এবং ইউটিউব চ্যানেল বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী নিয়ে ভিত্তিহীন গুজব ছড়িয়েছে। সেনাপ্রধানের বক্তব্য এসব গুজবের জবাবে একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে—সশস্ত্র বাহিনী সাংবিধানিক কাঠামো মেনেই চলবে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে সর্বত্র সহায়তা করবে। এটি কোনো হস্তক্ষেপের ঘোষণা নয় বরং বাহিনীর ভিতরে একটি বার্তা যেখানে সুস্পষ্ট ভাবে প্রতীয়মান হয় সেনাবাহিনী সংবিধান বাধ্য বাধকতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও অনুগত ।

সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা ও রাষ্ট্রীয় অভিপ্রায়:

সম্প্রতি সেনাবাহিনী এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধ্যে যে পারস্পরিক সমন্বয় ও বোঝাপড়া দৃশ্যমান হয়েছে সেটকে দেশ ও দশের প্রয়োজনে সেটিকে আরো নিকটতর ও সুদৃঢ় করতে হবে। জাতিসংঘ মহাসচিবের সাম্প্রতিক সফরে সেনাবাহিনীকে অন্তর্ভুক্তি কিংবা সেনাপ্রধান ও নিরাপত্তা উপদেষ্টার সৌহার্দ্যপূর্ণ বৈঠক ইঙ্গিত দেয় যে সেনাবাহিনী ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই দেশের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে। ব্যক্তিগত মতপার্থক্য থাকলেও রাষ্ট্রীয় স্বার্থে সকলেই ঐক্যবদ্ধ রয়েছেন এটিই ছিল সেনাপ্রধানের মূল বার্তা ।

উপসংহার:

যারা সেনাপ্রধানের বক্তব্যের ভেতর ষড়যন্ত্র বা অস্বাভাবিকতা খুঁজছেন, তারা হয় অজ্ঞতাবশত আর না হয় উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশের সার্বভৌমত্ব, ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং নির্বাচন পূর্ব বাস্তবতায় সেনাপ্রধানের এই বক্তব্য সময়োচিত, দায়িত্বশীল এবং প্রাসঙ্গিক। এটি কোনো রাজনৈতিক উচ্চারণ নয় বরং এটি ছিল একটি পেশাদার বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তার পক্ষ থেকে জাতির উদ্দেশ্যে অঘোষিত একটি অঙ্গীকার যেখানে সুস্পষ্ট করা হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা প্রশ্নে কোন আপস নয়।

লেখক : ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ড. একেএম শামছুল ইসলাম, পিএসসি, জি (অব.), সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *