সেনাবাহিনীর হাত ধরে মাদকমুক্ত দেশের স্বপ্ন

উৎপাদনকারী দেশ না হয়েও ভৌগোলিক বাস্তবতায় মাদকের সর্বগ্রাসী আগ্রাসনে পুরো বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক কেওয়াস, ব্যবসা-বিনিয়োগে খরাসহ অর্থনৈতিক দুর্দশা, কূটনৈতিক টানাপড়েনের আলোচনা-সমালোচনার ব্যতিব্যস্ততার ফাঁকে অনেকের অলক্ষে সেবনসহ মাদকের বিস্তার ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। দেশের কোনো কোনো লোকালয়ে ঘরে ঘরে মাদকের কারবার। নেশাগ্রস্ত সন্তানের হাতে মা-বাবা, স্বামীর হাতে স্ত্রী হত্যার মতো ঘটনা মাঝেমধ্যে প্রকাশ্যে এসে দিন কয়েক মাতামাতি পর্যন্তই সার।

নেই কোনো কার্যকর পদক্ষেপ। যার জেরে মাদকাসক্তির গ্রাস এখন সর্বত্র। এতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত তরুণসমাজ। মাদকাসক্তিতে তরুণসমাজের একটি বড় অংশ এখন দিকভ্রান্ত ও ধ্বংসপ্রায়।

মাদকের ভয়াল এই থাবা প্রজন্মের শিশু-কিশোরদের ভবিষ্যৎ যেমন করছে অনিশ্চিত, ঠিক তেমনি ধুঁকে ধুঁকে ছিন্ন করছে তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে মফস্বল শহর, দেশের প্রায় প্রতিটি প্রান্তরে এখন হেরোইন, মদ, ফেনসিডিলের মতো ছোট-বড়-মাঝারি—সব ধরনের মাদক সহজে মিলছে। দামও হাতের নাগালে। মাদকের বিষয়সংক্রান্ত বেশ কটি কর্তৃপক্ষ দেশে রয়েছে।

মাদক নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারের একটি অধিদপ্তরও আছে। কিন্তু অপ্রিয় সত্য হচ্ছে, তারা দমন নয়, প্রকারান্তরে নিজেদের মতো মাদক নিয়ন্ত্রণই করে। সেখানে বিশাল লগ্নি, নিয়োগ-বিনিয়োগ, লোভনীয় পদ-পদায়নের বিষয়-আশয় রয়েছে। আড়ালে যা মাদকের আরেক কারবার।

মাদক নিরাময়ে দেশে সরকারি-বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠান আছে, চিকিৎসাসহ পুনর্বাসন কেন্দ্রও আছে। এগুলোর কোনো কোনোটির ভেতরের খবর ভয়াবহ। মোট কথা, মাদকের আরেক কারবার। অনেক কারবারি সেগুলোর অংশীজন। অর্থ-সময়সহ আরো কিছুতে অল্পের মধ্যে বিশাল ধনবান হতে মাদকের কারবার দেশে ক্রমে বিস্তার লাভ করছে। বিশেষ বিশেষ জায়গায় কিছু খরচাপাতি করে কম সময়ে ঝক্কিঝামেলা ছাড়া ধনবান হওয়ার রাস্তা এটি। মানদণ্ড বিচারে মোটেই এটি ব্যবসা না। মাদককে ব্যবসা বলা ব্যবসায়ীদের জন্য অপমানের-অসম্মানের। ক্রেতা-বিক্রেতা শব্দার্থের প্রতিও অবিচার। মাদক কারবারিরা কেবল দেশের নয়, মনুষত্বেরও শক্র। এরা বিকৃত-ধিকৃত। ন্যূনতম মানবিকতাসম্পন্ন মানুষও মাদককে ঘৃণা করে। সরকারেরও মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স রয়েছে বলে প্রচারিত। এর মধ্যেও মাদকের বহু কারবারি। গাঁজা, ফেনসিডিল, চরস, ভাং, গুল, হেরোইন, প্যাথেডিন, ডিনেচার্ড স্পিরিট, মদ-বিয়ার, তাড়ি, মরফিন, আইস পিল, ভায়াগ্রা, সানাগ্রা, মিথাইল-ইথাইল, ইয়াবাসহ নানা মাদকের বহু গ্রাহক। মেঠো ভাষায় খোর।

এই খোরের সংখ্যা বাড়ানোর জন্যও কারবারিদের রয়েছে অনেক চেইন। সঙ্গে লগ্নিও। তাদের ছায়া বা হাতছানি দেশজুড়ে। শুধু শহর নয়, এখন গ্রামেও মাদকের ব্যাপক বিস্তার। এতে কেবল শহরের ধনীর দুলাল-দুলালি নয়, গ্রামের গরিব ঘরের সন্তানরাও হাত বাড়াচ্ছে মাদকের দিকে। বাড়ছে কাস্টমার। খুলছে মাদকের নতুন নতুন হাটবাজার। হাত বাড়ালেই মিলছে নেশার নানা দ্রব্য। পরিণতিতে ধ্বংস হচ্ছে মানুষের দেহ-মন, জ্ঞান-বিবেক, জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা স্বজনদের স্বপ্ন। খোয়া যাচ্ছে সামাজিক-পারিবারিক মানইজ্জত। ফল পরিবার, সমাজ, জাতি এবং পরবর্তী প্রজন্মও আক্রান্ত হচ্ছে। দেশে কত মানুষ মাদকাসক্ত—এর সঠিক কোনো হিসাব নেই। তা নির্ণয় করাও কঠিন। সংখ্যায় অগুনতি এই মাদকাসক্তদের একজনই একটি পরিবারে বা সমাজে অশান্তি-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট। এরা নিজেরা মরে, বাকিদেরও যন্ত্রণায় পোড়ায়-ভোগায়। তার ওপর মাদকের বিস্তারে নারী ও শিশুদের ব্যবহার ক্রমাগত বাড়ছে। কারবারিরা বিভিন্ন মাদক আমদানি, সরবরাহ ও বেচাকেনায় নিরাপদ হিসেবে নারী ও শিশুদের বেছে নিচ্ছে। মাদক দমন এবং নিয়ন্ত্রণের কিছু ব্যবস্থা থাকলেও নির্মূলের কার্যকর উদ্যোগ নেই। আইনেরও কমতি নেই। কিন্তু নেই সে ধরনের কোনো পদক্ষেপ। চাইলে চলমান সময়ে সেই সুযোগ নেওয়া যায়। এর জন্য নতুন কোনো আইন, প্রজ্ঞাপন বা বিধি-বিধান সংশোধনীর দরকার নেই। দরকার শুধু শক্ত সিদ্ধান্তের।

চব্বিশের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান সেই সুযোগটি এনে দিয়েছে। সেনাবাহিনী জনতার সঙ্গে এক হয়ে গণ-আন্দোলনের একটি চমৎকার ফয়সালা এনে দিয়েছে। তার ওপর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নিয়ে সেনাবাহিনী এখন মাঠে রয়েছে। যৌথ বাহিনীর অংশীজন হয়ে তারা পেশাদারির সঙ্গে দেশের চলমান পরিস্থিতিতে আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাদের কয়েকটি অভিযান ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। এসব অভিযানে হত্যা মামলার আসামি, অবৈধ অস্ত্রধারী, তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী, চোরাকারবারি, কিশোর গ্যাং সদস্য, অপহরণকারী, ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজ, মাদক কারবারি এবং মাদকাসক্ত পাকড়াও হচ্ছে। গ্রেপ্তার করা অপরাধীদের কাছ থেকে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র, বিভিন্ন ধরনের গোলাবারুদ, বোমা, বিভিন্ন মাদকদ্রব্য উদ্ধারও হচ্ছে। জননিরাপত্তা নিশ্চিতে বিভিন্ন এলাকায় সেনাবাহিনীর নিয়মিত টহল অব্যাহত আছে। অনেকের ধারণায়ও নেই, শিল্পাঞ্চলগুলোয় সম্ভাব্য অস্থিরতা রোধে মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে মতবিনিময় ও সমঝোতার মাধ্যমে বেতন-বোনাস পরিশোধে কী ভূমিকা রাখছে সেনা টহল দল। কয়েকটি অভিযানে সেনাদের অ্যাকশন মব পাণ্ডামিতে বড় রকমের ছেদ ফেলেছে। তাদের চলমান অভিযানের আওতা বিশেষভাবে মাদকের দিকে গেলে ফলাফল কেমন হতে পারে? সেই দৃষ্টান্ত মিলেছে নওগাঁয়। সেখানকার অস্থায়ী সেনা ক্যাম্পের সদস্যরা আকস্মিক অভিযানে কিছু মাদক কারবারির ওপর একঝলক ‘অ্যাকশন’ নিয়েছেন মাত্র। বাদবাকিদের এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এলাকা ছেড়ে তারা কোথায় চম্পট দিয়েছে কেউ বলতে পারছে না। অথচ কদিন আগেও মনে করা হতো, এরা পরাক্রমশালী। তাদের স্পর্শ করার ক্ষমতা কারো নেই। নওগাঁর বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে এটি আলোচিত বিষয়।

মাদক কারবারিরা নিশ্চয়ই পতিত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তদের চেয়ে শক্তিশালী নয়। তাদের রোখা যাবে না, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতায় মাঠে রাখার সিদ্ধান্ত দেশের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তাদের সুবাদে কেবল আইন-শৃঙ্খলা আয়ত্তে থাকছে না, দানবীয় মব সন্ত্রাস দমনে কিছু পদক্ষেপে সেনাবাহিনীর প্রতি সব পর্যায়ের মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরিয়ে এনেছে। মাদকের ভয়াল থাবার দিকে সেনাবাহিনীর পদক্ষেপও পরিস্থিতি বদলে দিতে পারে। মাদকের বিষয়ে পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রতি মানুষের ভরসা নষ্ট হয়ে গেছে বহু আগেই। এই পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী চাইলে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে মাদক সাম্রাজ্যেও আঘাত হানতে পারে। এ জন্য কোনো যুদ্ধ ঘোষণা জরুরি নয়। কারণ, এ কাজের এখতিয়ার সেনাবাহিনীর বিদ্যমান ম্যাজিস্ট্রেসির আওতাভুক্ত। সেই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুল থেকে শুরু করে পুলিশ এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মীদের ওপর বাধ্যতামূলক ডোপ টেস্ট চালু করা সময়ের দাবি। এ ছাড়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষার্থীদের জন্য এক ধরনের নিয়মিত মনিটরিং প্রক্রিয়া চালু করা যেতে পারে। সেনাবাহিনী এই প্রক্রিয়া তদারকি ও বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

বিশ্বের কিছু কিছু দেশে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে সামরিক বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। যেমন : ফিলিপিন্সে প্রেসিডেন্ট দুতার্তের আমলে মাদকের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনী ও পুলিশের যৌথ পদক্ষেপ ব্যাপক সাফল্য পেয়েছিল। মেক্সিকোতে ড্রাগ কার্টেলের বিরুদ্ধে পরিচালিত সেনা অভিযানও প্রশংসিত হয়েছে। ইরানে সীমান্তে মাদক পাচার রোধে সেনাবাহিনীর সহায়তায় কঠোর নিরাপত্তা বলয় গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশেও এখন একটি সুবর্ণ সময়, সেনাবাহিনীকে এই গুরুদায়িত্ব পালনে স্পষ্ট নির্দেশনা ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেওয়ার। ‘সময় গেলে সাধন হবে না’ লালনের এ কথাটি এ সময় মাদক নির্মূল প্রশ্নে বড় প্রাসঙ্গিক। কারণ রাজনীতিসহ অনিবার্য নানা বাস্তবতার কারণে একসময় হয়তো চাইলেও তাতে সফলতা পাওয়ার সুযোগ থাকবে না। মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে একবিংশ শতাব্দীতে কখনো কখনো সামরিক হস্তক্ষেপ এবং সন্ত্রাসবাদ দমনের প্রেক্ষাপটে যুদ্ধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ‘মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ শব্দটি গণমাধ্যমে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ১৯৭১ সালের ১৭ জুন এক সংবাদ সম্মেলনে রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন মাদকের অপব্যবহারকে ‘জনসাধারণের এ নম্বর শক্র’ ঘোষণায়।

লেখক : মোস্তফা কামাল, সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *