সেনাপ্রধান যা বললেন, কেন বললেন?

সেনাপ্রধানের যে বক্তব্য পত্র পত্রিকায় এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসেছে– সেটাকে বরং বলা উচিত ” আসতে দেয়া হয়েছে”। এটা ডেলিবারেট চয়েজ।।নইলে সেনা কর্মকর্তাদের সাথে মত বিনিময় আই এস পি আর এর মাধ্যম ছাড়াতো মিডিয়ায় আসার কথা না।

এটাকে আমরা সরকারের জন্য সিগন্যাল হিসাবে দেখতে পারি। কারণ জেনারেল ওয়াকারের কথাগুলো কি অযৌক্তিক? প্রথম শোনাতে মনে হয়নি। কিন্ত এইগুলো কিছুটা- রাজনৈতিকতো অবশ্যই।

সংসদ বিলুপ্ত, জনগনের সরাসরি প্রতিনিধিত্ব নাই এমন অবস্থা ও গন অভ্যুত্থানের ভিত্তিতে তৈরি সরকারে সেনাবাহিনীর স্টেক থাকাটা খুব স্বাভাবিক। সেই স্টেককে সরকার বাই পাস করছিলো- অন্তত জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে জেনারেল ওয়াকারের তাদের সাথে আলোচনা না করার মন্তব্য – এই সত্যকেই সামনে আনে।

সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছাড়া এই অভ্যুত্থান হতো না।।এটা সবাই মেনেই সরকার গঠন করেছে। জেনারেল ওয়াকার ক্ষমতা গ্রহণের সব সুযোগ থাকার পরেও প্রফেসর ইউনুসকে দিনের পর দিন সমর্থন দিয়ে গেছে। কিন্ত বিনিময়ে সেনাপ্রধানের সাথে ডিলিংস টা অনেকক্ষেত্রেই আন প্রফেশনাল হয়ে গেছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই দেশের সবচেয়ে পাওয়ারফুল অংশ প্রতিক্রিয়া দেখাবেই।।আমি বরং তাদের প্রতিক্রিয়ার মধ্যে সংযতভাব দেখি।।প্রতিক্রিয়া এর থেকে ভায়োলেন্ট হলেও কিছু করার ছিলো না।

তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম- জেনারেল ওয়াকারের আওয়ামী লীগের সাথে সক্ষ্য আছে। কিছুটা সহানুভুতি আছে। সো হোয়াট? উনি সেই রাগ অনুরাগকে কম্প্রোমাইজ করেই তো দেশের বৃহত্তর অংশের আকাঙ্ক্ষার সাথে সাড়া দিয়েছে।

আপনি সবাইকে শত্রু বানিয়ে দেশ চালাতে পারবেন না। আর সেই অংশ যদি হয় সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার দায়িত্বে- তাহলে তাদেরকে আস্থায় নিতেই হবে। তারা বেয়াড়া হলে পোশ মানাতে হবে। কিন্ত যেসব তথ্য সামনে আসছে তাতে বুঝা যায় – সরকার উলটা পথেই হেটেছে।। সরকারের যে অংশ টা ” আমাদের এভ্রিথিং এর ম্যান্ডেট ” আছে মনে করতো- সেই অংশটাই এতদিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাকিদের আদারিং করে।

অনেকে বলছে – সেনাপ্রধান এইসব এইভাবে না বলে এপ্রোপ্রিয়েট চ্যানেলে বলতে পারতো।।কিন্ত এই যুক্তির সমস্যা হচ্ছে উনারা কনটেক্সটকে জেনারালাইজ করে ফেলেছে।।প্রথমত সেনাপ্রধান পাবলিক স্পিচ দেয় নাই।।উনি সেনাকর্মকর্তাদের সাথে বৈঠকে এইসব বলেছে।।এবং সেনা কর্মকর্তারা জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে নিজেদের মধ্যে এইসব আলোচনা করবে- এটাই অস্বাভাবিক না। দ্বিতীয়ত সেনাপ্রধানকে জড়িয়ে সরকারের নানা সুবিধাভোগী অংশ যখন পাবলিক ন্যারেটিভ তৈরি করছিলো তখন সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে- এখন নৈতিক দিক থেকে সরকার শক্তিশালী অবস্থানে থাকতো।।নবগঠিত দলের( জনগনের বিশাল একটা অংশ মনে করে তারা কিংস পার্টি) শীর্ষ নেতা যেভাবে পাবলিকলি সেনাপ্রধানকে নিয়ে ” বিহাইন্ড দ্যা ডোর” তথ্যকে বিফোর পাবলিক করেছে- আর সরকার তাতে নির্লিপ্ত ও না দেখার ভান করেছে – তখন সেনাবাহিনী পালটা রিয়েক্ট করলে – সরকার নিবৃত করার মোরাল অথরিটি এপ্লাই করতে দ্বিধায় থাকবে স্বাভাবিক। সেই আলোচনা তখন বিহাইন্ড দ্যা কার্টেন হলে – এই আলোচনা গুলো বিহাইন্ড দ্যা কার্টেন হওয়ার লেজেটিমেসি স্ট্রংলি আর্গু করা যেত।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের রিয়েকশন দেখে মনে হচ্ছে- বি এনপি সেনাপ্রধানের এইসব বক্তব্যকে পজিটিভলি নিয়েছে।।আর নিরাপত্তা ইস্যুতে সেনাবাহিনীও সম্ভবত সেনাপ্রধানের বক্তব্যেই ধারণ করে৷ সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিশাল অংশ এই সরকারের সিদ্ধানহীনতা ও রিটালিয়েটরী একশনে বিরক্ত।। তারাও প্রকাশ্যে না হলেও নীরব ভাবে সেনাপ্রধানের বক্তব্যকে পজিটিভলি নিবে।। নির্বাচিত সরকারের জন্য অপেক্ষা করছে।

এই সরকারের প্রশাসনিক অনভিজ্ঞতায় নানা ডি ফ্যাক্টো পাওয়ার পকেট তৈরি হওয়ার প্রশাসন বিভ্রান্ত- কার কথা শুনবে? শুনলে কি হবে? না শুনলে কি হবে? প্রেসিডেন্ট হামিদের বিদেশ গমন নিয়ে পুলিশের মধ্যম ও নিম্ন পদস্ত কর্মকর্তাকে শাস্তি এই সরকারের ব্লান্ডারের সর্বশেষ উদাহরণ।।একজন বয়োবৃদ্ধ এবং এক্স প্রেসিডেন্টকে নিয়ে নাটক করার দরকার ছিলো না।।আমাদের দেশের ক্ষমতা কাঠামোয় প্রেসিডেন্ট ঠুটো জগন্নাথ। তাছাড়া প্রেসিডেন্টদের এক ধরনের ইনডেমনিটি থাকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি হওয়ায়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্যাপিটল হিলের ঘটনায় কনভিক্টেড হয়েও ইনডেমনিটির আওতায় রক্ষা পেয়েছে। আসল কালপ্রিটেদের কাউকে গ্রেফতার করতে না পেরে প্রেসিডেন্টের মত ঠুটো “ট্রফি পারসন”কে নিয়ে এত মাতামাতি সরকারের নার্ভাসনেস ও অক্ষমতার চুড়ান্ত প্রকাশ। সব মিলিয়ে সেনাবাহিনীর কাছ থেকে যে রিয়েকশন এসেছে সেটাকে আমার খুব ওয়াইল্ড ও উচ্চ বিলাসী মনে হয়নি।।বরং দেশে একটা নির্বাচন ও পলিটিকাল সেটেলমেন্টের প্রতি তাদের কমিটমেন্ট রেইনফোর্সড হয়েছে।

সরকার রাষ্ট্রের শক্তিশালী ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে সিগনাল পেয়েছে। এরপরেও যদি না বুঝে কি স্ট্রাটেজিতে আগাবে আর সামনের দিনে কিভাবে দেশ চালাবে- তাহলে আত্মঘাতি হবে।।আমরা প্রত্যক্ষ সেনা শাসন চাই না।।আমরা চাই সেনাবাহিনী আমাদের নিরাপত্তা দিবে, রক্ষা করবে। সেনাবাহিনীও সম্ভবত সেটাই চায়।কিন্ত যারা এখন রাষ্ট্র পরিচালনায়- তারা কি চাচ্ছে এটাও গুরুত্বপূর্ন।।তবে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর যত প্রলম্বিত হবে- দেশে নানা অস্থিরতা তত বাড়বে।

প্রফেসর ইউনুস সম্ভবত সবচেয়ে হার্স যে সিগনাল পেয়েছে- জাতিসংঘ আর আন্তর্জাতিক চাওয়াকে দিয়ে দেশ চলে না।অন্তত বন্দর ও রাখাইন করিডর নিয়ে উনার সিদ্ধান্ত সম্ভবত ঝুলে গেল। এবং এটা উনার একপ্রকার পরাজয়। এনজিওর সিদ্ধান্ত নেয়া আর রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত নেয়াযে ভিন্ন সেটা উনি শিখলেন।।কিন্ত শিখতে গিয়ে রাষ্ট্রের ক্ষতি হয়ে গেলো কিনা- সেটা এসেসমেন্ট ও করতে হবে।

লেখা কৃতজ্ঞতাঃ Baten Mohammed

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *